বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:বাঙালির প্রাণের উৎসব শারদোৎসব। পশ্চিমবাংলার বাঙালি সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এই উৎসবের জন্য। আচার–আচরণের ঊর্ধ্বে উঠে ধর্ম–বর্ণ নির্বেশেষে নানা শ্রেণির মানুষ মিশে যান এই উৎসবে। বিশাল একটা অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলে উৎসবের ক’দিন। যেমন মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, প্রতিমা নির্মাণ, প্রতিমার সাজসজ্জা, ফলমূল, ফুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় খাবারের দোকান, গাড়িভাড়া, সব মিলিয়ে যে অর্থনৈতিক কাজকর্ম ক’দিন ধরে চলে, তাতে শুধু হিন্দু নন, যুক্ত থাকেন মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি, জৈন, শিখ থেকে নানা ধর্ম ও জাতির মানুষ। আর মাত্র কয়েকদিন। তার পরই হওয়ার কথা সেই শারদীয় দুর্গাপুজো।
তবে, কথা হল, শারদীয় উৎসব তো শুধু এ বছর নয়, আগামী বছরও আসবে। বছরের পর বছর ঘুরে আসতেই থাকবে। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এ বছরের শারদোৎসবই না ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে আপামর মানুষের! চিকিৎসক মহল থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই বিষয়টি নিয়ে বারবার সতর্ক করে আসছিলেন। এক বছরের জন্য পুজো বন্ধ রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হল, কে দেবে এই পুজো বন্ধের নির্দেশ? দিতে পারে রাজ্যের সরকারই। —না, সরকার সেই নির্দেশ দেয়নি। বরং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদিনই নিয়ম করে বহু পুজোর উদ্বোধন করে চলেছেন। এর মধ্যে সময় গড়িয়ে গিয়েছে অনেকটাই। রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই পুজো আয়োজনের কাজ প্রায় শেষ। ইতিমধ্যে রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাও হয়েছে। এমতাবস্থায় পুজো বন্ধের নির্দেশ তাই দিতে পারেনি আদালত। বরং পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, পুজো হোক। তবে তা হোক একেবারে দর্শকশূন্য।
বিদ্যুৎ দফতরের প্রাক্তন কর্মী হাওড়ার বাসিন্দা অজয়কুমার দে–র করা এক জনস্বার্থ মামলায় রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে পুজোয় ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তার ব্লু প্রিন্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সোমবার সেই ব্লু প্রিন্ট রাজ্য সরকারের তরফে জমা দেওয়া হয়নি। তাই এদিন সকালেই হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, দুর্গাপুজোর সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে। সেই কারণে মণ্ডপে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার থাকলে তাঁরা সেখানে যাবেনই। তাই প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর আদালত তখন জানিয়েছিল, প্রতিটি মণ্ডপকে কনটেইনমেন্ট জোন ঘোষণা করে দেওয়া উচিত। এদিন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আজই খবরের কাগজে পুজো মণ্ডপগুলিতে ভিড়ের যে ছবি দেখেছি, তা আশঙ্কা তৈরি করেছে। অতিমারি রুখতে যে গাইডলাইন রয়েছে, তাতে সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।’ শুধু তাই নয়, তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে সেই নির্দেশ পালন করবে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হল, পুলিশের সংখ্যা কি পর্যাপ্ত?’
রাজ্য সরকার আদালতে জানিয়েছিল, পুজোয় রাস্তায় থাকবে ৩০ হাজার পুলিশ। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘শুধু কলকাতা শহরেই তিন হাজারেরও বেশি পুজো হচ্ছে। আর পুলিশ মাত্র ৩০ হাজার! বাড়ালে বড় জোর ৩২ হাজার হবে।’ তার মানে প্রতি পুজোতে মাত্র ১০ জন করে পুলিশ থাকবে। স্বভাবতই বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘এই সংখ্যার পুলিশ দিয়ে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা করে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, তদন্তের কাজ সেরে আদৌ পুজো সামলানো কি সম্ভব?’ তখনই হাইকোর্টের মত কী, তা স্পষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। এদিন সরকারের হয়ে আদালতে সওয়াল করেছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত এবং আবেদনকারী অজয় দে–র আইনজীবী ছিলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তার পরই বিকেলে সেই নজিরবিহীন রায় দিল হাইকোর্ট। জানিয়ে দিল, রাজ্যের সমস্ত পুজোমণ্ডপকে ‘নো এন্ট্রি’ জোন হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। মণ্ডপের মুখে লাগিয়ে দিতে হবে ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড। আর হাইকোর্টের এই নির্দেশ কী ভাবে কতটা মানা হল, তা হলফনামা দিয়ে লক্ষ্মীপুজোর পর আদালতকে জানাবে রাজ্য সরকার। ৫ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার সেই হলফনামা হাইকোর্টে জমা দেবেন।
এদিন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অরিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, ছোট থেকে বড় সমস্ত মণ্ডপের ৫ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত দূরত্ব ব্যারিকেড করে দিতে হবে। সেখানে কোনও দর্শক ঢুকতে পারবেন না। মণ্ডপে শুধু পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ জন যেতে পারবেন। সেই নামের তালিকাও পুলিশকে আগে জমা দিতে হবে। আদালতের রায় ঘোষণার পর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা প্রতিটি মণ্ডপকে কনটেইমেন্ট জোন ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেছিলাম। হাইকোর্ট নো এন্ট্রি জোন করার নির্দেশ দিয়েছে। হাইকোর্টের এই নির্দেশ পুলিশকে কার্যকর করতে হবে।’